এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা : নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন
বাস্তবায়নে বিএডিসির অভীষ্ট
মোঃ জামাল উদ্দীন
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (ঝউএং) বিশ্বব্যাপী উচ্চাভিলাষী এবং চ্যালেঞ্জিং প্রকৃতির হিসাবে স্বীকৃত। বাংলাদেশও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়; তবে, বাংলাদেশ সরকার নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাই বিভিন্ন পর্যায় থেকে বহুমুখী উদ্যোগ ও কর্ম পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এটা ধরে নেওয়া হয় যে কার্যকর এবং নিয়মিত অগ্রগতি ট্র্যাকিং আমাদের পথে সাফল্যের চাবিকাঠি হবে।
বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার আকাঙ্খা করছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক নির্ধারিত এই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যগুলো ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার এজেন্ডার সাথে মিলে গেছে যা এর সকল সদস্য রাষ্ট্রের দ্বারা গৃহীত হয়েছিল। এটি ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বত্র মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতির জন্য সমস্ত সদস্য দেশগুলির দ্বারা পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানোর একটি এজেন্ডা ছিল। এটি সর্বজনীন, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অবিভাজ্য যেখানে নেতারা বিশ্বকে ক্ষুধামুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, এবং ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতিটি দেশের প্রতিটি মানুষের জন্য শান্তিও সমৃদ্ধি নিয়ে আসবে।
এসডিজি অর্জনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) সংজ্ঞায়িত মিশন হচ্ছে ‘বিভিন্ন ফসলের উচ্চ ফলনশীল বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও সরবরাহ বৃদ্ধি; সেচ প্রযুক্তির উন্নয়ন; ভূপৃষ্ঠের পানির সর্বোত্তম ব্যবহার; সেচের দক্ষতা বৃদ্ধি করা এবং সেচযোগ্য এলাকা বৃদ্ধি এবং মানসম্পন্ন সার সরবরাহ করতে। সংজ্ঞায়িত ভিশন হল মানসম্পন্ন কৃষি উপকরণ সরবরাহ এবং দক্ষ সেচ ব্যবস্থাপনা। যা কৃষি মন্ত্রণালয় ও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত বিশ্ব খাদ্য দিবস-২০২৩ এর প্রতিপাদ্য ‘পানি জীবন, পানিই খাদ্য। কেউ থাকবে না পিছিয়ে’। সফল বাস্তবায়নে বিএডিসি কাজ করে যাচ্ছে।
এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ৬. নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন (সকলের জন্য পানি ও স্যানিটেশনের টেকসই ব্যবস্থাপনা ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা) নিয়ে বিএডিসির অভীষ্ট ও লক্ষ্যমাত্রা হলো - ৬.৪.২: জলের চাপের স্তর ও স্বাদুপানির সম্পদের অনুপাত হিসাবে স্বাদুপানি উত্তোলন করা।
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে বিএডিসির ক্ষুদ্রসেচ উইং এর ভূমিকা অপরিহার্য। ১৯৬০ এর দশকে মাত্র ১,৫৫৫টি শক্তিচালিত পাম্পের মাধ্যমে ভূউপরিস্থ পানি ব্যবহারের লক্ষ্যে বিএডিসি কর্তৃক দেশে আধুনিক সেচ ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ব্যবস্থার প্রচলন ঘটে। ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার ছিল নগণ্য। ১৯৬৭-৬৮ সালে ১০২টি গভীর নলকূপ এবং ১৯৭৩-৭৪ সালে ৯৯৮টি অগভীর নলকূপ স্থাপন করে ভূগর্ভস্থ ও ভূউপরিস্থ পানির ব্যবহার শুরু হয়। তখন প্রায় ৯৫% ভূউপরিস্থ এবং % ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার হতো। পরবর্তীকালে ক্ষুদ্রসেচ উইং বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ ও ভূউপরিস্থ পানির ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবহারে সেচ ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সুবিধা সম্প্রসারণ করে খাদ্য উৎপাদনে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে সারাদেশে আবাদযোগ্য জমি ৮৫ লক্ষ হেক্টর সেচযোগ্য জমি ৭৬ লক্ষ হেক্টর এবং সেচকৃত জমির পরিমাণ ৫৬.২৭ লক্ষ হেক্টর। ক্ষুদ্র সেচের মাধ্যমে গত বোরো মৌসুমে ৭২.৫% সেচযোগ্য জমিতে সেচ প্রদান করা হয়েছে। খাদ্য উৎপাদনে দেশে দুই ধরনের সেচ কার্যক্রম প্রচলিত আছে- বৃহৎ সেচ ও ক্ষুদ্র সেচ। রবি মৌসুমে ক্ষুদ্র সেচের মাধ্যমে ৯৫% এবং বৃহৎ সেচের মাধ্যমে ৫% জমিতে সেচ প্রদান করা হচ্ছে। তন্মধ্যে সারাদেশে ভূউপরিস্থ পানির সাহায্যে ২৭.১০% এবং ভূগর্ভস্থ পানির সাহায্যে ৭২.৯% জমিতে সেচ প্রদান করা হচ্ছে।
বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার-২০১৮ অনুযায়ী পুষ্টিসম্মত ও নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা ও কৃষি ব্যবস্থায় যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে সুখী-সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে রূপকল্প -২০২১ সফলভাবে সম্পন্নকরণের মাধ্যমে মধ্যম আয়ের দেশ, ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি (ঝউএ) বাস্তবায়ন, ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশের মর্যাদা অর্জন এবং শতবর্ষী বদ্বীপ পরিকল্পনা (উবষঃধ চষধহ-২১০০) এর আলোকে বিএডিসি ক্ষুদ্রসেচ উইং খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বহুমুখী সেচ সেবা কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। এই উইং এর উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম নিচে দেয়া হলো:
খাল/নালা/পুকুর খনন/পুনঃখনন/সংস্কার কার্যক্রমের মাধ্যমে ভূউপরিস্থ পানির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণপূর্বক সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ এবং জলাবদ্ধতা দূর করে জলাবদ্ধ ও অধঃপতিত জমি আবাদি জমিতে রূপান্তরকরণ।
অনাবাদী জমি সেচের আওতায় আনয়নপূর্বক সেচ এলাকা বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখা।
পানি সাশ্রয়ী অর্থাৎ যে সকল ফসলের সেচ কম লাগে সে সকল ফসলের আবাদ বৃদ্ধির মাধ্যমে সেচ খরচ হ্রাসকরণ।
অচল/অকেজো গভীর/ফোর্সমোড নলকূপ সচলকরণের মাধ্যমে লাগসই ও টেকসই সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ।
বিদ্যুৎচালিত সেচযন্ত্রসমূহের বিদ্যুতায়ন নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে সেচ খরচ হ্রাসকরণ।
সেচযন্ত্রে স্মার্টকার্ড বেইজ্ড প্রিপেইড মিটার স্থাপনের মাধ্যমে সেচ দক্ষতা ও সেচের পানির অপচয় রোধকরণ।
নবায়নযোগ্য শক্তি যেমন- সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, বায়োগ্যাস ইত্যাদি ব্যবহারের মাধ্যমে সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ।
সেচ কাজে ভূূউপরিস্থ পানিসম্পদের প্রাপ্যতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে লাগসই ও টেকসই প্রযুক্তির ব্যবহার, সম্প্রসারণ ও সুসংহত করার কার্যক্রম গ্রহণ (যেমন: রাবার/হাইড্রোলিক এলিভেটর ড্যাম নির্মাণ)।
সৌরশক্তিচালিত পাতকুয়া স্থাপনের মাধ্যমে সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ।
পাহাড়ি এলাকায় আর্টেশিয়ান নলকূপ স্থাপনের মাধ্যমে কম খরচে সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ।
বারিড পাইপ ও পাকা সেচনালা, আধুনিক ড্রিপ ও স্প্রিংকলার সেচ ব্যবস্থা স্থাপনের মাধ্যমে সেচ এলাকা সম্প্রসারণ, সেচের পানির অপচয়রোধ, সেচ খরচ হ্রাস, সেচের নিবিড়তা এবং সেচ দক্ষতা বৃদ্ধিকরণ।
ভূূউপরিস্থ পানির প্রাপ্যতাবিহীন এলাকায় ফোর্সমোড নলকূপ স্থাপন।
ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার হ্রাসকরণের মাধ্যমে ভূূউপরিস্থ পানির ব্যবহার বৃদ্ধিকরণ।
পাহাড়ি এলাকায় স্থায়ী জলাধার তৈরি এবং সেচ কার্যক্রম পরিচালনা।
ফসলের ফলন পার্থক্য কমানো।
AWD (Alternate Wetting and Drying), ফিতা পাইপ ও পোর্টেবল/মোভেবল সেচ পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে সেচের পানির অপচয় রোধ করে সেচ খরচ কমানো এবং সেচদক্ষতা বৃদ্ধিকরণ।
সেচ, পানি ব্যবস্থাপনা ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ওপর একটি কেন্দ্রীয় তথ্য ভান্ডার গড়ে তোলা এবং মাঠ পর্যায়ে কৃষক পর্যন্ত ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে পৌঁছানো।
পানি সাশ্রয়ী সেচ প্রযুক্তি এবং পরিবেশবান্ধব পলিশেড নির্মাণের মাধ্যমে নিরাপদ ও রপ্তানিযোগ্য সবজি, ফুল ও ফল উৎপাদন বৃদ্ধিকরণ।
বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে সেচ সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ।
ভূগর্ভস্থ লবণ পানির অনুপ্রবেশ মনিটরিং এর মাধ্যমে সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির লবণাক্ততা পর্যবেক্ষণ এবং লবণাক্ততা নিরূপণের মাধ্যমেMap Salinity Intrusion Map তৈরিকরণ।
ক্ষুদ্রসেচ উন্নয়নের লক্ষ্যে সেচযন্ত্র, সেচ এলাকা, সেচের পানি ইত্যাদির নিয়মিত জরিপ, অনুসন্ধান, পানির গুণাগুণ পরীক্ষাকরণ, ভূগর্ভস্থ পানি মনিটরিং এ অটো ওয়াটার লেভেল রেকর্ডার ও ডাটা লগার স্থাপন এবং পর্যবেক্ষণ নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ স্থিতিশীল পানির স্তর পরিমাপ করে Ground Water Zoning Map তৈরিকরণ;
Smart Agricultural Practice, Space Technology (ST), Remote Sensing (RS), Geophysical Survey এর মাধ্যমে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, তথ্য সংগ্রহ, আধুনিক প্রযুক্তি যেমন:Geographic Information System (GIS) Modelling এর মাধ্যমে বিশ্লেষণ, পরিবীক্ষণপূর্বক সুপারিশ প্রণয়ন, প্রচার এবং ডাটাবেজ উন্নয়ন ও সরকারকে তা অবহিতকরণ।
সেচ বিভাগসহ অন্যান্য উইং সংস্থা/অধিদপ্তরের অফিস ভবন/স্থাপনা নির্মাণ, মেরামত রক্ষণাবেক্ষণকরণ;
মাঠ পর্যায়ে কৃষি কাজে ভূগর্ভস্থ পানি আইন-২০১৮ ও তদীয় বিধিমালা-২০১৯ অনুযায়ী সেচযন্ত্রের লাইসেন্স প্রদান;
সংস্থার নির্মাণকাজ বাস্তবায়নের জন্য পিপিআর/সংশ্লিষ্ট বিধি অনুযায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্তি ও নবায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ।
নির্মাণ কাজের ড্রইং, ডিজাইন ও প্রাক্কলন প্রণয়ন এবং মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নে কারিগরি দিকনির্দেশনা প্রদান;
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য সংস্থার চাহিদার প্রেক্ষিতে নির্মাণ কাজের প্রয়োজনীয় ড্রইং, ডিজাইন, প্রাক্কলন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।
সর্বোপরি কৃষি ব্যবস্থা যান্ত্রিকীকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণে সহায়তা প্রদান।
লক্ষ্যমাত্রা
বিএডিসির মাধ্যমে ৭.৬০ লক্ষ হেক্টর সেচ এলাকা টেকসইকরণ;
সেচ দক্ষতা ৩৮% থেকে ৫০% এ উন্নীতকরণ;
সেচ কাজে ভূউপরিস্থ পানির ব্যবহার ৩০% এ উন্নীতকরণ;
সেচ কাজে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার ৭০% এ হ্রাসকরণ।
সময়মত ও পরিমাণমত ফসলে সেচের ব্যবস্থা করা;
কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে পরিবেশের সাথে তালমিলিয়ে স্বল্প সময়ে কৃষি জমি তৈরি, ফসল সংগ্রহ, কর্তন এবং পরবর্তী ফসল নষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা;
“অন ফার্ম ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট” বিষয়ে কৃষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সচেতন করে তোলা।
বিএডিসির বার্ষিক কর্ম পরিকল্পনায় অত্যন্ত নিবিড়ভাবে এবং সতর্কতার সাথে ঝউএ এং বাস্তবায়ন ও অর্জনের যত্ন নেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও যে সকল পক্ষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে (কৃষক, প্রকল্প অফিস ইত্যাদিসহ) বিএডিসির ঝউএ লক্ষ্যমাত্রা ৬.৪.২ সেই অনুযায়ী অর্জন করা সম্ভব হবে মর্মে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
লেখক : উপপ্রধান (পরিকল্পনা) ও এসডিজি বিষয়ক ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা বিএডিসি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৯১৪০১২৪৮৮, ই-মেইল : mdjamal1984@gmail.com